দুই সপ্তাহেরও কম সময় আগে, ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের ঘোষণায় এটা উঠে এসেছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে মন্থরতা নিয়ে আসবে না। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক কঠোর আর্থিক নীতিমালা আরোপের বিষয় নিয়ে ট্রেডারদের উদ্বেগ কিছুটা হলেও কমেছে।
উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি নির্মূল করার জন্য ফেড পুঁজিবাজারকে সংকটের মুখে ফেলে দিতে পারে এমন আশঙ্কার ফলে 2020 সালের মার্চ থেকে মহামারী পরবর্তী সময়কালে S&P 500 সূচকে সর্বোচ্চ সাপ্তাহিক দরপতন হয়েছে (5.7%)।
কর্পোরেট খাতের ভবিষ্যত নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগের কারণে শেয়ারবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পাশাপাশি দেশটির সামিষ্টিক পরিসংখ্যানের অবনতির ফলে আর্থিক লোকসান হতে যাচ্ছে।
ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুচরা পণ্যের বিক্রয় আগের মাসের তুলনায় 1.9% কমেছে, যদিও বিশেষজ্ঞরা উল্লিখিত সূচকের এইরূপ পরিবর্তন আশা করেননি।
গত মাসে, দেশটির শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ 0.3%-এর বৃদ্ধি প্রত্যাশা করা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা 0.1% কমেছে।
জানুয়ারিতে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোক্তা আস্থা সূচক ডিসেম্বরের 70.6 পয়েন্ট থেকে 68.8 পয়েন্টে নেমে গেছে, যা গত এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্তর।
সপ্তাহ শেষে 15 জানুয়ারী বেকারভাতার জন্য মার্কিন জনগণের প্রাথমিক আবেদনের সংখ্যা 55,000 থেকে বেড়ে 286,000 এ পৌঁছেছে, যা অক্টোবরের মাঝামাঝির পর থেকে সর্বোচ্চ।
সম্প্রতি রয়টার্সের জরিপ অনুসারে বিশ্লেষকগণ মতামত দিয়েছেন যে, বার্ষিক ভিত্তিতে মার্কিন অর্থনীতি সম্ভবত গত ত্রৈমাসিকে 5.9% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যা চলতি বছরে 2.9%-এ নেমে আসবে। এই পরিসংখ্যান মাত্র এক মাস আগের পূর্বাভাস 6.0% এবং 4.0% থেকে কম।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেশজ পণ্যের উৎপাদন ২০২১ সালের 5.6% এর তুলনায় চলতি বছর এবং আগামী বছরে গড়ে 3.8% এবং 2.5% বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
জরিপের উত্তরদাতাদের বেশিরভাগই উল্লেখ করেছেন যে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি আগামী 12 মাসে মার্কিন অর্থনীতির জন্য বিশাল বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
ফেডারেল রিজার্ভের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের সাম্প্রতিক বিবৃতি থেকে ধারনা করা যাচ্ছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য কাজ করবে না, বরং, পণ্যের দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াই করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের মূল হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি কাটিয়ে উঠতে চায়, সেইসাথে ব্যালেন্স শীটে সিকিউরিটিজের পরিমাণ হ্রাস করছে।
এই দুটি ভিন্ন নীতিমালা কীভাবে একই ফলাফল নিয়ে আসবে তা বিতর্কের বিষয়, সেইসাথে মুদ্রাস্ফীতির উপর এগুলোর সম্ভাব্য প্রভাব ফেড নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
কিছু বিশ্লেষক ধারণা করছেন যে অদূর ভবিষ্যতে তিনবার সুদের হার বৃদ্ধি এবং হ্রাসকৃত ব্যালেন্স শীটের পাশাপাশি 2% মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার সাথে পণ্যের সঙ্গতিপূর্ণ মূল্য বৃদ্ধির জন্য ফেডকে আরও কিছু করতে হবে। অন্যরা বলছেন যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সম্ভবত, আকস্মিকভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। উপরন্তু করোনভাইরাসের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং শ্রমবাজার ও মুদ্রাস্ফীতির সূচকের ভিত্তিতে ফেড আর্থিক নীতিমালা সমন্বয় করবে।
গোল্ডম্যান শ্যাক্সের কৌশলবিদগণ চলতি বছরের মার্চ মাসে থেকে শুরু হওয়া প্রতিটি আলোচনা সভায় ফেড কর্তৃক সুদের হার বাড়ানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। সর্বমোট সাত বার অর্থাৎ মার্চ, মে, জুন, জুলাই, সেপ্টেম্বর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে ফেডের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তবে, ব্যাংকগুলোর প্রাথমিক পূর্বাভাস অনুসারে চার ত্রৈমাসিকে সুদের হার বৃদ্ধির (মার্চ, জুন, সেপ্টেম্বর এবং ডিসেম্বরে) সভাবনা রয়েছে। এছাড়াও জুলাই মাসে ব্যালেন্স শীট থেকে সিকিউরিটিজ বাদ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
গোল্ডম্যান শ্যাক্সের বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন, "মুদ্রাস্ফীতির বৃদ্ধির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্থিক নীতিমালায় কঠোরতা আরোপের প্রক্রিয়া কিছুটা হলেও ত্বরান্বিত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির সার্বিক চিত্র পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রত্যেক সভায় কাজ করবে এমন সম্ভাবনা রয়েছে। সুদের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা বা মে মাসে ব্যালেন্স শীট থেকে সিকিউরিটিজ হ্রাস করার কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা থেকে ধারনা করা যাচ্ছে চলতি বছরে চারবারেরও বেশি সুদের হার বৃদ্ধি করা হতে পারে,"।
এদিকে, সোসাইটি জেনারেলের বিশ্লেষকগণ ধারণা করছেন যে ফেড সম্ভবত ট্রেডারদের আশাহত করতে পারে বিশেষত যারা 2022 সালের দ্বিতীয়ার্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালেন্সের শীটে থেকে সক্রিয়ভাবে সিকিউরিটিজ হ্রাস শুরু করার প্রস্তুতি ও চারবারের বেশি সুদের হার বৃদ্ধির উপর ভিত্তি করে মূল্য নির্ধারণ করছে।
তারা উল্লেখ করেছেন, "যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্য দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে তাদের নীতিমালায় সহনীয়তা বজায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে,"।
মার্কিন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা আশা করছেন যে ওমিক্রন ধরনের ফলে সৃষ্ট কোভিড-১৯ এর সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাব শীঘ্রই কমে যাবে, তবে এটি ইতিমধ্যে কর্মসংস্থান এবং জাতীয় অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের গতি কমিয়ে দিয়েছে।
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ এখন ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাকরির সংকট দেখা দিবে। এর ফলে ফেডকে কর্মসংস্থান হ্রাসের মুখে মার্চ মাসে সুদের হার বাড়ানোর ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
"পিরিওড অভ সাইলেন্স"-এর উদযাপনের প্রাক্কালে, আটলান্টা ফেডের প্রেসিডেন্ট রাফায়েল বস্টিক বলেছেন যে মুদ্রাস্ফীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কতটা কমবে তার উপর সংশয়ের গভীরতা আংশিকভাবে নির্ভর করছে।
যদি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে যায় এবং আরও বেশি কর্মী তাদের চাকরিতে ফিরে আসে, পণ্য ও পরিষেবার সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং মজুরি বৃদ্ধির গতি হ্রাস পায়, বা বৈশ্বিক সরবরাহের বিভ্রাট কমে যায় তবে মুদ্রাস্ফীতি কমতে পারে।
তবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
রাফায়েল বোস্টিক বলেছেন যে, "করোনাভাইরাস মহামারী প্রাদুর্ভাবের আগে, ফেড ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতিকে 2% এর লক্ষ্যমাত্রা স্তরের নীচে রাখার জন্য লড়াই চালিয়ে আসছিল এবং সফলতাও অর্জন করেছিল, এবং এটি ধারনা করা যায় যে আমরা মহামারী কাটিয়ে উঠার সাথে সাথে পূর্বের অবস্থান আবারও দখল করব, তাই আমাদের এই ধরনের কঠোর নীতিমালার প্রয়োজন হবে না। তবে, মহামারীতে আক্রান্ত হওয়ার পর আমরা কেউই ভাবিনি যে মুদ্রাস্ফীতি এখনকার মতো বেশি হবে। তাই প্রশ্ন হল মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আমাদের ঠিক কিরকম প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত, ".
যদিও মার্চ পর্যন্ত ফেড সুদের হার বাড়াতে পারবে না, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে চলমান উদ্বেগ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর আর্থিক নীতিমালা আরোপের সম্ভাবনা ট্রেডারদের নিরাপদ সম্পদ কিনতে বাধ্য করছে।
শুক্রবার ওয়াল স্ট্রিটের প্রধান সূচকসমূহ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, এবং 10-বছরের মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের মুনাফা টানা দ্বিতীয় দিনের মতো 2% এরও বেশি কমেছে। যার ফলে ডলার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপরীতে শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারেনি।
গত বৃহস্পতিবার ডলারের সূচক এক সপ্তাহের সর্বোচ্চ 95.85-এ উন্নীত হয়েছিল, যা গত পাঁচ দিন আরও হ্রাস পেয়ে 95.60-এর কাছাকাছি অবস্থান করছে।
এদিকে, শুক্রবার ট্রেডিং চলাকালীন সময়ে EUR/USD পেয়ারের মূল্য প্রবণতা 1.1360 -এর লক্ষ্যমাত্রা স্তর স্পর্শ করলেও পুনরায় 1.1340-এ ফিরে এসেছে। তবুও, দিনের শেষে, ইউরোর দাম মার্কিন ডলারের বিপরীতে প্রায় 0.3% বেড়েছে।
তবে গ্রিনব্যাক বা মার্কিন ডলার সাম্প্রতিক পতনের পরে বেশ দ্রুতই শক্তিশালী অবস্থানে ফিরে এসেছে। তবে EUR/USD পেয়ার উর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রাখতে পারেনি এবং নতুন সপ্তাহের শুরুতে শক্তিশালী অবস্থান হারাতে শুরু করেছে।
মার্কিন পুঁজিবাজারের মূল সূচকসমূহ বেশিরভাগই সোমবারে গড়ে 2-3% হ্রাস পাচ্ছে। এর মূল কারণ বিনিয়োগকারীরা 25-26 জানুয়ারীতে আসন্ন ফেডের সভার সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে চলমান অনিশ্চয়তা ডলারের মূল্য প্রবণতায় উর্ধ্বগতি বজায় রাখছে এবং EUR/USD পেয়ারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বর্তমানে, মার্কিন ডলার সূচক 0.4% এর বেশি বৃদ্ধির সাথে 96.00-তে লেনদেন করা হচ্ছে।
পরবর্তী রেসিস্ট্যান্স লেভেলগুলো হচ্ছে 96.46 (4 জানুয়ারী থেকে 2022 সালের পর থেকে সর্বোচ্চ) এবং 96.93 (24 নভেম্বর 2021 সালের পর থেকে সর্বোচ্চ)।
গ্রিনব্যাক এখনও 200-দিনের চলমান গড় অনুযায়ী গঠনমূলক অবস্থান নিয়েছে, যা এখন 93.25-এ রয়েছে।
"বেয়ারিশ" চাপের মধ্যে থাকার কারণে, সোমবার EUR/USD পেয়ারের মূল্য প্রবণতা 1.1300 লক্ষ্যমাত্রার ঠিক নিচের স্তরে নেমে গেছে যা গত দুই সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন।
ক্রেডিট সুইস EUR/USD পেয়ারের সাম্প্রতিক বৃদ্ধিকে সাধারণ সংশোধন হিসেবে বিবেচনা করছে এবং ধারনা করছে যে এই পেয়ারের মূল্য প্রবণতা 1.1272 লক্ষ্যমাত্রা স্তরের নিচে নামলে পরবর্তীতে নিম্নমুখী মূল্য প্রবণতার ইঙ্গিত দিবে।